আমেরিকা , সোমবার, ১২ মে ২০২৫ , ২৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
ডেট্রয়েটের ক্যাম্পাস মার্টিয়াসে কিশোর ছুরিকাহত, আটক ১ গেজেট প্রকাশের পর আ.লীগের নিবন্ধন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি মিশিগানে পর্যটন মৌসুমে শুল্কের ছায়া মিশিগানের কারাগারে নারী বন্দীদের ‘নগ্ন তল্লাশি’, রাজ্য নীতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বিশ্বজুড়ে মা দিবস আজ ডেট্রয়েটে গুলিতে ২ জন নিহত, ১১ বছরের শিশুসহ আহত ২ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো সরকার জরুরি আলোচনায় বসেছে উপদেষ্টা পরিষদ ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় থামল যুদ্ধ 'মা দিবস' নয়, এবার 'স্পেশাল পিপল ডে' গ্রোস পয়েন্টে স্কুলের সিদ্ধান্ত ঘিরে বিতর্ক  অ্যাম্বাসেডর ব্রিজে ৩ মিলিয়ন ডলারের কোকেনসহ ট্রাকচালক গ্রেপ্তার ২০২৫ সালের অসাধারণ গ্র্যাজুয়েটদের সম্মান জানাল ডেট্রয়েট নিউজ ফেডারেল তদন্তে শিশু যৌন নিপীড়ন চক্রের হদিস, মেট্রো ডেট্রয়েটের ৫ জন গ্রেপ্তার ফোর্ড গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনায় ডিয়ারবর্নে চারজন গ্রেপ্তার অবশেষে আইভী গ্রেফতার ডিয়ারবর্ন হাইটস পুলিশে যৌন হেনস্থার অভিযোগ সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশ কবিগুরুর জন্মদিন আজ  দেশ ছাড়লেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সংগীত হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত : তারেক রহমান

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন 

  • আপলোড সময় : ১১-০৫-২০২৫ ০১:০৯:৫৩ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১১-০৫-২০২৫ ০১:০৯:৫৩ অপরাহ্ন
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন 
অনন্ত জীবনের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বিষয়ে কবির ভাগনি সরলাদেবী চৌধুরানী রচিত 'জীবনের ঝরাপাতা' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কবি তখন ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। সেদিন ভোরের মায়াবি অরুণিমায় নিজের হাতে বাড়ির বকুল ফুলের একটা মালা আর বাজার থেকে আনা বেলফুলের মালার সাথে নানারকম ফুল ও একজোড়া ধুতি- চাদর কবির পায়ের কাছে রেখে তিনি প্রণাম করে কবির জীবনে জন্মদিনের প্রথম উৎসব পালন করেন। এর সূত্র ধরে আমরা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি জন্মোৎসব বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করব। 
 
 কবি যখন পঞ্চাশে পা রাখলেন তখন শান্তিনিকেতনে আত্মীয় পরিজন, ছাত্র শিক্ষকদের শ্রদ্ধার্ঘে প্রীতিস্নিগ্ধ আড়ম্বরহীন উৎসব পালিত হয়। "১৩১৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৫০তম জন্মদিন পূর্তি উপলক্ষে তা শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দি অতিক্রম করে সর্বসাধারণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযে, বোলপুরে প্রচণ্ড গরম ও শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মাবকাশের কারণে কবির জন্মদিন সেখানে ১৩৪৩ সাল থেকে পঁচিশে বৈশাখের পরিবর্তে প্রতিবৎসর ১লা বৈশাখের দিন উদযাপিত হতে থাকে । " ১ 

১৩১৮ এ রবীন্দ্রনাথের বয়স ৫০ পূর্ণ হল। এ জন্মদিন উপলক্ষে পরিবারের বাইরে জন্মোৎসব শুধু শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ থাকেনি,সর্ব সাধারণের প্রাণের আলোয় সে উৎসব অপূর্ব বর্ণগরিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই বিচিত্র বিপুল উৎসব কবিকে প্রথম প্রকাশ্য সংবর্ধনায় অভিষিক্ত করে।   
"সেই দিন প্রাতের সভায় অজিত কুমার চক্রবর্তী তাঁহার রবীন্দ্রনাথ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করেন। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থখানিতে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে আলোচনা হইয়াছে , তাহাকে আজ পর্যন্ত কেহ 'পুরাতন' বলিয়া তাচ্ছিল্য করিতে পারেন নাই। এই গ্রন্থই রবীন্দ্র -সাহিত্যের প্রথম প্রবেশক। " ২

৫০ পূর্তি জন্মোৎসবের বর্ণাঢ্য বিবরণ আছে সীতা দেবীর 'পুণ্যস্মৃতি' গ্রন্থে। সেদিন আম্রকুঞ্জে উৎসবের হিরণ্ময় আল্পনা, নানাবিধ পত্রপুষ্প, উপহারসামগ্রী, ছাত্রসহ দিনেন্দ্রনাথের সংগীত পরিবেশন,বিধুশেখর শাস্ত্রী কর্তৃক অভিনন্দনপত্র পাঠ, অসংখ্য ফুলহারে ভূষিত কবি, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়সহ কলকাতা থেকে আগত রবীন্দ্রানুরাগীদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, সন্ধ্যায় 'রাজা' নাটকের অভিনয় সর্বোপরি আধঘণ্টাব্যাপী আনুমানিক ৩০০ লোকের প্রণাম -পর্ব ইত্যকার অনুষঙ্গে শান্তিনিকেতন এক অনির্বাচ্য দীপ্তি লাভ করে। 

কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সারা দেশের প্রতিনিধি রূপে ১৪ মাঘ, ১৩১৮ যে উৎসবের আয়োজন করেন এতে শ্রী যতীন্দ্রমোহন বাগচী রচিত 'বাণীবরতনয় আজি স্বাগত সভা মাঝে/
 অযুত চিত কমলে যেথা আসন তব রাজে'_ /গানটি পরিবেশিত হয়। সভাপতি সারদাচরণ মিত্র কবিকে একটি স্বর্ণ পদ্ম প্রদান করেন।অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত দৃষ্টিনন্দন পদ্মের পাপড়িগুলো ইচ্ছামত খোলা ও বন্ধ করা যেত । 
সভায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন, যা হাতির দাঁতের পাত্রে উৎকীর্ণ ছিল। 

কয়েকদিন পর আরেকটি অভ্যর্থনা সভায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত হাতির দাঁতের পাত্রে উৎকীর্ণ স্বরচিত কবিতা কবিকে উপহার দেন_
'জগৎ কবি সভায় মোরা তোমারি করি গর্ব্ব/
 বাঙালি আজি গানের রাজা, বাঙালি নহে খর্ব্ব।'

 এসব আয়োজন কবির বিরোধী পক্ষের পছন্দ ছিল না। তাঁরা পত্রাঘাতে কবিকে বিদ্ধ করতে থাকেন। কবি উদ্যোক্তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে এই দুঃখজনক তিক্ত পরিস্থিতি থেকে বারবার পরিত্রাণ চেয়েছেন। কিন্তু ভারতবর্ষসহ বিশ্বের রবীন্দ্রানুরাগীদের হার্দিক প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও মঞ্জরিত হতে থাকে। 

রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছরের জন্মদিন (১৩৩৮) ছিল ভক্ত জনের শ্রদ্ধা ভালোবাসার বিচিত্র উৎসার , ব্যাপকতা আর মহিমায় সর্বাপেক্ষা সমারোহপূর্ণ উৎসব । শান্তিনিকেতনে আম্রকুঞ্জে অনুষ্ঠানের শুরুতে বিধু শেখর শাস্ত্রী কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় স্বরচিত কবিতা পাঠ, ক্ষিতিমোহন সেন কর্তৃক কবি আবাহন মন্ত্র পাঠ, 'হে চির নূতন আজি এ দিনের প্রথম গানে ','আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ইত্যাদি সংগীতের সুর মূর্ছনা আর কবির অনিন্দ্য সুন্দর অভিভাষণ, চিন দেশের কবি কর্তৃক স্বরচিত চৈনিক কবিতা আবৃত্তি, চিনা চিত্রকর কর্তৃক ছবি উপহার সবমিলিয়ে অনুষ্ঠানস্থলকে অপূর্ব লাবণ্যশ্রী দান করে।

৭০ বছরের জন্মোৎসবে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলের বিরাট সভায় সভাপতি ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। সি.ভি. রমণ, বিপিনচন্দ্র পাল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ও শিক্ষাজগতের বহু বিদ্বান ব্যক্তির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত ও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সুনীল দাসের 'জন্মদিনের মুখর তিথি ' ও পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ 'গ্রন্থে এই আয়োজনের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। বিচিত্র মাত্রিক, ব্যাপক এই উৎসব বিষয়ে কবি পরম পরিতুষ্টি ব্যক্ত করেন। 

এ উৎসবের আলো সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। শিলচর, মজঃফরপুর, বগুড়া, পুরী টাঙ্গাইল, গৌহাটি প্রভৃতি স্থানে সাড়ম্বরে উৎসব পালিত হয়। এমনকি হিজলি বন্দীনিবাসের রাজবন্দীরাও মানপত্রের মাধ্যমে কবিকে অভিনন্দিত করেন। যা উৎসব বলয়ে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করে। 
 
সময়ের অমোঘ স্রোতে একদিন এলো জীবনের শেষ জন্মদিন।(১৩৪৮)।সেদিন শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠান অনাড়ম্বর হলেও সারা দেশ ছিল প্রাণবন্যায় স্বতঃস্ফূর্ত। সেদিন সকালে শান্তিনিকেতনে বৈতালিক গান, মন্দিরে উপাসনা, উত্তরায়ণে কবিকে সমবেত প্রণামের মাধ্যমে দিনটি যাপন করা হয়। কবি সানন্দে সকলের প্রণাম গ্রহণ করেন। অসুস্থতা নিয়েও আশ্রম বালিকাদের পরিবেশিত 'বশীকরণ' নাটক উপভোগ করেছেন । 

৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মহাত্মা গান্ধী ও মার্শাল চিয়াং কাইসেক কবিকে শুভেচ্ছাবার্তায় অভিনন্দন জানান। 

শেষ জন্মদিন বিষয়ে কবি অনেক কবিতা,গান রচনা করেছেন। আমরা একটি কবিতা চয়ন করব। এতে জন্মদিন বিষয়ে কবির বিশিষ্ট অনুভূতি শতধারায় উৎসারিত হয়েছে। কবিতাটি কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত কাব্য 'শেষ লেখা'র ১০ সংখ্যক কবিতা _
 
আমার এ জন্মদিন মাঝে আমি হারা /
আমি চাহি বন্ধুজন যারা/
তাহাদের হাতের পরশে/
মর্তের অন্তিম প্রীতি রসে/
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,/
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ/ শূন্য ঝুলি আজিকে আমার /
দিয়েছি উজাড় করি/
যাহা কিছু আছিল দিবার /
প্রতিদানে যদি কিছু পাই/
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা/
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই /
পারের খেয়ায় যাব যবে/
ভাষাহীন শেষের উৎসবে। "/

সুদীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় 
দেশে বিদেশে পালিত জন্মোৎসব উপলক্ষে চিঠি, গান, কবিতা আর অভিভাষণে রবীন্দ্র -অনুভব নব নব বর্ণ বিভঙ্গে পাখা মেলেছে। কবির আন্তর জীবনের সুগভীর উপলব্ধি এসবে ধ্বনিত। মানুষের জীবন অনন্ত জীবনের খণ্ডাংশমাত্র এ বোধও এসবে দিব্য রাগে স্ফুট হয়েছে। 
 কখনো কবি সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, তথা বিশ্বব্যাপারিক ঘটনায় উদ্বেগ আর পরিবেদনায় কাতর, কখনো আবার পৃথিবী ও মানুষের সাথে নিবিড় একাত্মতার মাঝে জন্মদিনের চরিতার্থতা অনুভব করেছেন। 
বস্তুত, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধ, দার্শনিকতা,মানবমুখীনতা, জন্ম মৃত্যু বিষয়ে নিজস্ব ধারণা, পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আকুলতা, আত্মানুধ্যান, আত্মবিশ্লেষণ, আত্মউপলব্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি কবির শিল্পব্যক্তিত্বের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ভাস্বর হয়ে আছে। 

প্রকৃতপক্ষে জীবনকে দেখার গভীর অন্তর্দৃষ্টির আলোকে রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিটি জন্মদিনই ছিল নতুন। অপরূপ রূপবৈভব আর লাবণ্যপ্রভায় চিত্তরঞ্জী। প্রাণের অনন্ত ঝরনাধারা আর অরুদ্ধ অন্তরাত্মার নিরন্তর স্পন্দনে তরঙ্গিত। 
এ প্রসঙ্গে জন্মদিন বিষয়ে কবির লেখা একটি গান আমরা চয়ন করব। এটি কবির নিজের সুর করা শেষ গান। সবদিক থেকেই গানটির বিশিষ্টতা ও কাব্য মূল্য অপরিমেয়।

আসলে রবীন্দ্রনাথের কাছে জন্মদিন হল, জীর্ণ জরা সরিয়ে দিয়ে অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্যের দীপ্র কাঙ্ক্ষা। কুহেলির শৃঙ্খল ভেঙে প্রদীপ্ত সূর্যের মত কবি সর্বব্যাপ্ত হতে চান। উদয় দিগন্তের শঙ্খ ধ্বনি তাঁকে মরণজয়ী জীবনের গান শোনায়। কবি এখানে জীবনের গভীরতর প্রত্যয়ে অবিচল। তাঁর কণ্ঠে তাই অবিরল ধ্বনিত হতে থাকে অবিনাশী জীবনের বিজয় উল্লাস, হিরণ্ময় মহিমা _
"হে নূতন 
দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উৎঘাটন, 
সূর্যের মতন।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন। 
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়, 
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়। 
উদয় দিগন্তে 
শঙ্খ বাজে, 
মোর চিত্ত মাঝে 
চির নূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ । "

তথ্যসূত্র 
১শুভ জন্মদিন, সম্পাদক মুনমুন গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পৃ১০। 
২রবীন্দ্র জীবনী (২),প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, পৃ৩১৭।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স