হবিগঞ্জ, ১৬ এপ্রিল : দেখতে দেখতে চলে তিনটি বছর। করোনার মহামারিতে যখন আমরা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলাম সামাজিক দুরত্ব মেনে চলায়, সেই ২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন সমাজঘনিষ্ট ব্যাক্তি এবং আইন ও বিচারাঙ্গনের প্রিয়মূখ এডভোকেট আবুল খায়ের। পরোপকার, সবার প্রশংসা, পেশার প্রতিভালবাসা এবং অনেক আইনজীবীর আলোর দিশারী এডভোকেট আবুল খায়ের এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও আমাদের কাছে তার স্মৃতি এখনও অম্লান। বিচারাঙ্গনে এখনও তার নাম স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধার সাথে। আজ তার ৩য় মৃত্যু বার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলী।
এডভোকেট আবুল খায়ের ছিলেন শতভাগ পেশাদার আইনজীবী। এই পেশার যে নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং পেশার প্রতি নিবেদন তা তার সবকিছুর উপস্থিতি ছিল সুদীর্ঘ আইন পেশায়। এর বাহিরেও সমাজে সামাজিক ব্যাক্তি হিসাবে তার আলাদা একটা পরিচিতি ছিল। আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় মরহুম এডভোকেট আবুল খায়েরের উপস্থিতি সব সময় আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো। এডভোকেট আবুল খায়ের এর সাথে আমার সম্পর্ক এবং চলাফেরা ছিল বহুমাত্রিকভাবে। শুরুটা সাংবাদিকতা পেশার জন্য। পরে বঙ্গবন্ধু পরিষদে এক সাথে কাজ করা এবং শেষে তার জুনিয়র হিসাবে আইনপেশায় চলে আসা। যে কোন ক্ষেত্র থেকেই যদি তার মূল্যায়ন করতে হয়, তবে কোনটিকে আগে রাখবো সেটা নিয়েই হিমশিম খেতে হয়। কারণ সকল দিকেই তার ভূমিকা ছিল আমার কাছে অতুলনীয়। নিজের বয়সের তুলনায় তার সাথে ঘনিষ্টভাবে চলার বয়স একেবারেই কম ছিল না। তার জীবনের শেষ দিকে অনেক বিষয় নিয়েই তার সাথে চলাফেরা করতে গিয়ে উপলদ্ধি করেছি তিনি বয়সে যতই প্রবীণ হোননা কেন তার মাঝে সদা বিরাজমান ছিল শিশুর মন। এডভোকেট আবুল খায়ের এর মূল পরিচয় তিনি আইনজীবী। আইন পেশার প্রতি তার মনোনিবেশ এমন ছিল যে, এই পেশা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য অন্য কোন কিছুর সাথে জড়াতেন না। বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ হলেও তিনি তা এড়িয়ে যেতেন। সময়মত কোর্টে যাওয়া। শুনানীর আগেই সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত থাকা। সন্ধ্যায় চেম্বার করা। মামলার জন্য নিখুত প্রস্তুতি গ্রহণ এবং প্রস্তুতি অনুযায়ী শুনানী করা। এ ধরনের মনোনিবেশ এখন মফস্বলে খুবই কম দেখা যায়। আইনজীবী হিসাবে তার সবচেয়ে সফলতা; তিনি জুনিয়রদের জন্য ছিলেন আলোর দিশারী।
হবিগঞ্জে তিনি যে পরিমাণ জুনিয়রকে অভিভাবকত্ব করেছেন এবং সফল আইনজীবী তৈরি করেছেন তা বিরল। একজন জুনিয়র এই চ্যালেঞ্জিং পেশা থেকে যাতে ছিটকে না যায়, তার জন্য তিনি দিন শেষে জুনিয়রের হাতে সম্মানী তুলে দিতেন, কাজের বিবেচনা না করেই। এডভোকেট আবুল খায়ের এর সাথে জুনিয়র বা সহযোগী হিসাবে অনেক সিনিয়ররাও কাজ করতেন। হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি এডভোকেট মোঃ আবু জাহিরকে তিনি আপন ভাইয়ের ন্যায় স্নেহ করতেন এবং সাথে নিয়ে আইন প্র্যাকটিস করতেন। এর আগে সাবেক মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ তার প্রতিবেশী হওয়ায় তাকেও তার সাথে বিভিন্ন মামলায় নিতেন। এ ব্যাপারে আবুল খায়ের আমাদেরকে স্মৃতিচারণ করে বলতেন “মোস্তফা শহীদ সাহেব আমার চেম্বারে সকাল বেলা এসে বলতেন আজ আমি কোন কোন মামলায় আছি”। রাজনীতিবীদ হিসাবে তিনি ব্যস্ত থাকায় বিভিন্ন মামালায় তাকে সাথে রাখতেন। জেলা আওয়ামী লীগ এর আরেক সাবেক সভাপতি মরহুম শরীফ উদ্দিনও তার সাথে বিভিন্ন মামলায় সাথে থাকতেন। মরহুম আলমগীর ভূইয়া বাবুল ভাই জীবনের শেষ পর্যন্ত তার সাথে থেকেই আইন পেশা চালিয়েছেন। সব সময় তার চেম্বার জুনিয়রে থাকত ভরপুর। তার কোন জুনিয়র যে কোন পর্যায়ে সফল হলে তিনি সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হতেন। বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ থাকলে সেখানে যাওয়ার জন্য জুনিয়রদেরও তিনি অনুপ্রেরণা দিতেন। পেশায় তিনি যেভাবে মনোযোগ দিতেন সেভাবে তার চেম্বারের ফিও ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে টাকা বেশী দিলেও মোয়াক্কেলরা তার কাছে এসে মানসিক তৃপ্তি পেত বলেই বার বার আসত ।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি এডভোকেট আবু জাহির যাতে ভাল ফলাফল করতে পারেন তার জন্য তিনি দিনরাত প্রচারণা চালাতেন। বিভিন্ন স্থানে টেলিফোনে খোঁজ-খবর নিতেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও অনেক এলাকায় গিয়ে বৈঠক করেছেন। লাখাই উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট মুশফিউল আলম আজাদের গত নির্বাচনে তিনি লাখাই সড়কের অবস্থা নাজুক হওয়ার পরও অসুস্থ শরীর নিয়ে চলে যান বিভিন্ন এলাকায়। এই ছিল জুনিয়র এবং ঘনিষ্টজনদের প্রতি তার ভালবাসার নিদর্শন। আর তিনি সবসময় মেলামেশা এবং আড্ডা পছন্দ করতেন। তার চেয়ে বয়সে অনেক কম ঘনিষ্টজনকে তিনি ভাই এবং আপনি বলে সম্বোধন করতেন এবং অনেক সম্মান দিতেন। তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা দিতেন। অনেক সময় চলে যেতেন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। আর বাসায় গেলেই চা এবং নাস্তা না করিয়ে তিনি কাউকে ফেরত দিতেন না। এই আড্ডার জন্য তিনি আমেরিকা গেলেও দেশে চলে আসতে ব্যকুল হয়ে পড়তেন। তিনি সব সময় গুণিজনকে সম্মান করতেন। দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের প্রতি ছিল তার মমতা আর ভালবাসা। এডভোকেট আবুল খায়ের ছিলেন হবিগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার প্রচুর জানাশোনা ছিল। সবসময় বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার কথা বললে তিনি বলতেন যত টাকা লাগে দিব কিন্তু ভাল অনুষ্ঠান করতে হবে। ভাল ভাল লোকজনকে এই সংগঠনে সম্পৃক্ত করতে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করতেন। এডভোকট আবুল খায়ের ছিলেন একজন সংবাদপত্র সেবী ও সাংবাদিকের বন্ধু। নব্বইয়ের দশকে তিনি সাপ্তাহিক স্বদেশ বার্তাকে পৃষ্টপোষকতা করেছেন। জীবনের শেষ সময়েই ছিলেন দৈনিক দেশজমিনের সাথে জড়িত। সাংবাদিকরা যে কোন কাজে আসলে তিনি খুশি হতেন এবং সহযোগিতা করতেন। সাংবাদিকরাও তাকে সম্মান করতেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় পত্রিকায় কলাম এবং মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতেন। বাসায় সব স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি ৩/৪টি জাতীয় পত্রিকা রাখতেন। দেশের
সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিদেশী সংবাদও গুরুত্ব দিয়ে পড়তেন। পরে সেগুলো ঘনিষ্টজনদের সাথে আলোচনা করতেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভাল কাজকে অভিনন্দন জানাতেন। আর কোন দুঃখজনক ঘটনায় শোক প্রকাশ করতেন। পত্রিকায় তার কোন লেখা বা নিউজে তার বক্তব্য আসলে খুবই খুশি হতেন। নিদেন পক্ষে তার নামটি সংবাদপত্রে দেখলেই তিনি খুশিতে আত্মহারা হতেন।
এডভোকেট আবুল খায়েরের আরেকটি পরিচয় হল তিনি চা শিল্প ও চা বাগানকে খুবই ভালবাসতেন। পেশাগতভাবে তিনি সকল চা বাগানের আইন উপদেষ্টা বলেই নয়, এই ভালবাসা ছিল নিছক আন্তরিকতা থেকে। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন চা বাগানে ছুটে যেতেন। আর কোন চা বাগানের সমস্যা হলে তিনি যত কাজই হাতে থাক বা অবেলায়ই হোক ছুটে যেতেন সবার আগে। শুধু বাগান ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতরাই নন, তাকে ভালবাসতে শ্রমিকরাও। তার পিতা মরহুম আবুল হোসেন ছিলেন চুনারুঘাট উপজেলার জারুলিয়া গ্রামের কিংবদন্তি ব্যবসায়ী। ওই গ্রামের প্রতি আবুল খায়েরের ভালবাসা ছিল আন্তরিকতায় ভরপুর। নিজ এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা আর এতিমখানায় তার সহযোগিতার হাত সব সময় প্রশারিত থাকত। তিনি নিজ এলাকা এবং হবিগঞ্জকে খুবই ভালবাসতেন। আমেরিকার গ্রিণকার্ড খুব সহজেই নষ্ট করে দেন দেশ ও এলাকার প্রতি ভালবাসা থেকে। তিনি সব সময় বলতেন হবিগঞ্জ তার খুবই ভাল লাগে। বিদেশে গেলে আড্ডা মিস করেন। ঢাকায় গেলেও
অশান্তি বোধ করেন। জীবের শেষ বেলা তার চিকিৎসা হয় ভারতের চেন্নাইয়ে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় যখন তার মৃত্যু হয় তখন সারা বিশ্বেই করোনার কারনে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ। যে দেশ ও এলাকাকে তিনি এতবেশি ভালবাসেন সেই দেশে তার লাশ আসবে কিনা তা নিয়ে দেখা দেয় চরম অনিশ্চয়তা। তবে তার বড় মেয়ের জামাতা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম-সচিব হওয়ায় তিনি ঠিকই বিশেষ ব্যবস্থায় তার লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। আর তার অতিপ্রিয় জারুলিয়ার মাটিতেই শায়িত হওয়ার সুযোগ পান। পরে গাজীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে আবুল খায়েরের নামে একটি সড়কের নামকরণ করেন। এডভোকেট আবুল খায়ের তিন বছর আগে না ফেরার দেশে চলে গেলেও তিনি তার কর্মে আমাদের হৃদয়ের মনিকোটায় বেচে থাকবেন চির ভাস্কর হয়ে।
লেখক :
আইনজীবী ও সাংবাদিক
এডভোকেট আবুল খায়ের ছিলেন শতভাগ পেশাদার আইনজীবী। এই পেশার যে নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং পেশার প্রতি নিবেদন তা তার সবকিছুর উপস্থিতি ছিল সুদীর্ঘ আইন পেশায়। এর বাহিরেও সমাজে সামাজিক ব্যাক্তি হিসাবে তার আলাদা একটা পরিচিতি ছিল। আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় মরহুম এডভোকেট আবুল খায়েরের উপস্থিতি সব সময় আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো। এডভোকেট আবুল খায়ের এর সাথে আমার সম্পর্ক এবং চলাফেরা ছিল বহুমাত্রিকভাবে। শুরুটা সাংবাদিকতা পেশার জন্য। পরে বঙ্গবন্ধু পরিষদে এক সাথে কাজ করা এবং শেষে তার জুনিয়র হিসাবে আইনপেশায় চলে আসা। যে কোন ক্ষেত্র থেকেই যদি তার মূল্যায়ন করতে হয়, তবে কোনটিকে আগে রাখবো সেটা নিয়েই হিমশিম খেতে হয়। কারণ সকল দিকেই তার ভূমিকা ছিল আমার কাছে অতুলনীয়। নিজের বয়সের তুলনায় তার সাথে ঘনিষ্টভাবে চলার বয়স একেবারেই কম ছিল না। তার জীবনের শেষ দিকে অনেক বিষয় নিয়েই তার সাথে চলাফেরা করতে গিয়ে উপলদ্ধি করেছি তিনি বয়সে যতই প্রবীণ হোননা কেন তার মাঝে সদা বিরাজমান ছিল শিশুর মন। এডভোকেট আবুল খায়ের এর মূল পরিচয় তিনি আইনজীবী। আইন পেশার প্রতি তার মনোনিবেশ এমন ছিল যে, এই পেশা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য অন্য কোন কিছুর সাথে জড়াতেন না। বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ হলেও তিনি তা এড়িয়ে যেতেন। সময়মত কোর্টে যাওয়া। শুনানীর আগেই সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত থাকা। সন্ধ্যায় চেম্বার করা। মামলার জন্য নিখুত প্রস্তুতি গ্রহণ এবং প্রস্তুতি অনুযায়ী শুনানী করা। এ ধরনের মনোনিবেশ এখন মফস্বলে খুবই কম দেখা যায়। আইনজীবী হিসাবে তার সবচেয়ে সফলতা; তিনি জুনিয়রদের জন্য ছিলেন আলোর দিশারী।
হবিগঞ্জে তিনি যে পরিমাণ জুনিয়রকে অভিভাবকত্ব করেছেন এবং সফল আইনজীবী তৈরি করেছেন তা বিরল। একজন জুনিয়র এই চ্যালেঞ্জিং পেশা থেকে যাতে ছিটকে না যায়, তার জন্য তিনি দিন শেষে জুনিয়রের হাতে সম্মানী তুলে দিতেন, কাজের বিবেচনা না করেই। এডভোকেট আবুল খায়ের এর সাথে জুনিয়র বা সহযোগী হিসাবে অনেক সিনিয়ররাও কাজ করতেন। হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি এডভোকেট মোঃ আবু জাহিরকে তিনি আপন ভাইয়ের ন্যায় স্নেহ করতেন এবং সাথে নিয়ে আইন প্র্যাকটিস করতেন। এর আগে সাবেক মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ তার প্রতিবেশী হওয়ায় তাকেও তার সাথে বিভিন্ন মামলায় নিতেন। এ ব্যাপারে আবুল খায়ের আমাদেরকে স্মৃতিচারণ করে বলতেন “মোস্তফা শহীদ সাহেব আমার চেম্বারে সকাল বেলা এসে বলতেন আজ আমি কোন কোন মামলায় আছি”। রাজনীতিবীদ হিসাবে তিনি ব্যস্ত থাকায় বিভিন্ন মামালায় তাকে সাথে রাখতেন। জেলা আওয়ামী লীগ এর আরেক সাবেক সভাপতি মরহুম শরীফ উদ্দিনও তার সাথে বিভিন্ন মামলায় সাথে থাকতেন। মরহুম আলমগীর ভূইয়া বাবুল ভাই জীবনের শেষ পর্যন্ত তার সাথে থেকেই আইন পেশা চালিয়েছেন। সব সময় তার চেম্বার জুনিয়রে থাকত ভরপুর। তার কোন জুনিয়র যে কোন পর্যায়ে সফল হলে তিনি সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হতেন। বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ থাকলে সেখানে যাওয়ার জন্য জুনিয়রদেরও তিনি অনুপ্রেরণা দিতেন। পেশায় তিনি যেভাবে মনোযোগ দিতেন সেভাবে তার চেম্বারের ফিও ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে টাকা বেশী দিলেও মোয়াক্কেলরা তার কাছে এসে মানসিক তৃপ্তি পেত বলেই বার বার আসত ।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি এডভোকেট আবু জাহির যাতে ভাল ফলাফল করতে পারেন তার জন্য তিনি দিনরাত প্রচারণা চালাতেন। বিভিন্ন স্থানে টেলিফোনে খোঁজ-খবর নিতেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও অনেক এলাকায় গিয়ে বৈঠক করেছেন। লাখাই উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট মুশফিউল আলম আজাদের গত নির্বাচনে তিনি লাখাই সড়কের অবস্থা নাজুক হওয়ার পরও অসুস্থ শরীর নিয়ে চলে যান বিভিন্ন এলাকায়। এই ছিল জুনিয়র এবং ঘনিষ্টজনদের প্রতি তার ভালবাসার নিদর্শন। আর তিনি সবসময় মেলামেশা এবং আড্ডা পছন্দ করতেন। তার চেয়ে বয়সে অনেক কম ঘনিষ্টজনকে তিনি ভাই এবং আপনি বলে সম্বোধন করতেন এবং অনেক সম্মান দিতেন। তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা দিতেন। অনেক সময় চলে যেতেন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। আর বাসায় গেলেই চা এবং নাস্তা না করিয়ে তিনি কাউকে ফেরত দিতেন না। এই আড্ডার জন্য তিনি আমেরিকা গেলেও দেশে চলে আসতে ব্যকুল হয়ে পড়তেন। তিনি সব সময় গুণিজনকে সম্মান করতেন। দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের প্রতি ছিল তার মমতা আর ভালবাসা। এডভোকেট আবুল খায়ের ছিলেন হবিগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার প্রচুর জানাশোনা ছিল। সবসময় বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার কথা বললে তিনি বলতেন যত টাকা লাগে দিব কিন্তু ভাল অনুষ্ঠান করতে হবে। ভাল ভাল লোকজনকে এই সংগঠনে সম্পৃক্ত করতে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করতেন। এডভোকট আবুল খায়ের ছিলেন একজন সংবাদপত্র সেবী ও সাংবাদিকের বন্ধু। নব্বইয়ের দশকে তিনি সাপ্তাহিক স্বদেশ বার্তাকে পৃষ্টপোষকতা করেছেন। জীবনের শেষ সময়েই ছিলেন দৈনিক দেশজমিনের সাথে জড়িত। সাংবাদিকরা যে কোন কাজে আসলে তিনি খুশি হতেন এবং সহযোগিতা করতেন। সাংবাদিকরাও তাকে সম্মান করতেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় পত্রিকায় কলাম এবং মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতেন। বাসায় সব স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি ৩/৪টি জাতীয় পত্রিকা রাখতেন। দেশের
সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিদেশী সংবাদও গুরুত্ব দিয়ে পড়তেন। পরে সেগুলো ঘনিষ্টজনদের সাথে আলোচনা করতেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভাল কাজকে অভিনন্দন জানাতেন। আর কোন দুঃখজনক ঘটনায় শোক প্রকাশ করতেন। পত্রিকায় তার কোন লেখা বা নিউজে তার বক্তব্য আসলে খুবই খুশি হতেন। নিদেন পক্ষে তার নামটি সংবাদপত্রে দেখলেই তিনি খুশিতে আত্মহারা হতেন।
এডভোকেট আবুল খায়েরের আরেকটি পরিচয় হল তিনি চা শিল্প ও চা বাগানকে খুবই ভালবাসতেন। পেশাগতভাবে তিনি সকল চা বাগানের আইন উপদেষ্টা বলেই নয়, এই ভালবাসা ছিল নিছক আন্তরিকতা থেকে। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন চা বাগানে ছুটে যেতেন। আর কোন চা বাগানের সমস্যা হলে তিনি যত কাজই হাতে থাক বা অবেলায়ই হোক ছুটে যেতেন সবার আগে। শুধু বাগান ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতরাই নন, তাকে ভালবাসতে শ্রমিকরাও। তার পিতা মরহুম আবুল হোসেন ছিলেন চুনারুঘাট উপজেলার জারুলিয়া গ্রামের কিংবদন্তি ব্যবসায়ী। ওই গ্রামের প্রতি আবুল খায়েরের ভালবাসা ছিল আন্তরিকতায় ভরপুর। নিজ এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা আর এতিমখানায় তার সহযোগিতার হাত সব সময় প্রশারিত থাকত। তিনি নিজ এলাকা এবং হবিগঞ্জকে খুবই ভালবাসতেন। আমেরিকার গ্রিণকার্ড খুব সহজেই নষ্ট করে দেন দেশ ও এলাকার প্রতি ভালবাসা থেকে। তিনি সব সময় বলতেন হবিগঞ্জ তার খুবই ভাল লাগে। বিদেশে গেলে আড্ডা মিস করেন। ঢাকায় গেলেও
অশান্তি বোধ করেন। জীবের শেষ বেলা তার চিকিৎসা হয় ভারতের চেন্নাইয়ে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় যখন তার মৃত্যু হয় তখন সারা বিশ্বেই করোনার কারনে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ। যে দেশ ও এলাকাকে তিনি এতবেশি ভালবাসেন সেই দেশে তার লাশ আসবে কিনা তা নিয়ে দেখা দেয় চরম অনিশ্চয়তা। তবে তার বড় মেয়ের জামাতা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম-সচিব হওয়ায় তিনি ঠিকই বিশেষ ব্যবস্থায় তার লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। আর তার অতিপ্রিয় জারুলিয়ার মাটিতেই শায়িত হওয়ার সুযোগ পান। পরে গাজীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে আবুল খায়েরের নামে একটি সড়কের নামকরণ করেন। এডভোকেট আবুল খায়ের তিন বছর আগে না ফেরার দেশে চলে গেলেও তিনি তার কর্মে আমাদের হৃদয়ের মনিকোটায় বেচে থাকবেন চির ভাস্কর হয়ে।
লেখক :
আইনজীবী ও সাংবাদিক