মিশিগানে বাংলা সংস্কৃতির ছোঁয়া দেখলেন প্রথম কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত আচার্য

আপলোড সময় : ২৬-১০-২০২৫ ০৩:০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২৬-১০-২০২৫ ০৩:১৯:০৬ পূর্বাহ্ন
ওয়ারেন, ২৬ অক্টোবর : ভোর সকাল। সূর্য তখনও দিগন্তে মুখ দেখায়নি। অক্টোবরের মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় ডেট্রয়েট মেট্রো বিমানবন্দরে সস্ত্রীক অবতরণ করলেন ‘প্রথম কলকাতা’র প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুব্রত আচার্য। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মিশিগানের মাটিতে পা রাখার মুহূর্তে দীর্ঘ উড়ানের ক্লান্তি যেন মিলিয়ে গেল। বিমানবন্দরের উষ্ণ হাসি আর ফুলেল শুভেচ্ছায় এক অনন্য আবেগঘন স্বাগত মুহূর্ত।
গত ২১ অক্টোবর, সোমবার, দুই দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি মিশিগানে পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা শেষে তিনি প্রতিবেদকের স্টার্লিং হাইটস সিটির বাসভবনে আতিথ্য গ্রহণ করেন। প্রথম সকালটা কেটেছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ, হালকা আড্ডা আর এক কাপ গরম চায়ের সুবাসে। যেন এক মৃদু সূচনা, যার মধ্যে ছিল সফরের প্রথম উচ্ছ্বাস আর খানিক বিশ্রামের শান্ত সমন্বয়।

কিন্তু শান্ত সকালটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মিশিগানে পৌঁছার তিন ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় তাঁর কর্মব্যস্ত সময়সূচি। দেখা-সাক্ষাৎ, আলোচনার পর্ব, স্থানীয় প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে ভাববিনিময়সব মিলিয়ে এক প্রাণচঞ্চল দিন। সংবাদজগতের সক্রিয় এক প্রতিনিধি এবার মিশিগানের আকাশেও ছড়িয়ে দিলেন কলকাতার প্রাণস্পন্দন।
সকালে ঠিক ১১টায় তাঁর প্রথম গন্তব্য ছিল বাংলা প্রেসক্লাব মিশিগান। ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রেসক্লাব সভাপতি সৈয়দ শাহেদুল হক, সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল রেজা সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক মৃদুল কান্তি সরকার, আশিক রহমান ও চিন্ময় আচার্য্যসহ অনেকে।
অভ্যর্থনার জবাবে সুব্রত আচার্য কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, “দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও সাংবাদিকতার এই ঐক্য ও আন্তরিকতা সত্যিই অনুপ্রেরণার। প্রবাসের মাটিতে আপনাদের কাজ বাংলা সাংবাদিকতার মুখ উজ্জ্বল করছে।” উপস্থিত সকলে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে হাসি, আর এক বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণতার আবেশে ভরে উঠে। 
এরপর শুরু হয় শহর পরিভ্রমণ। বাংলা টাউন খ্যাত হ্যামট্রাম্যাক সিটি ঘুরে তিনি মিশিগানের সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন। তার সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেদক এবং প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক মৃদুল কান্তি সরকার। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি বাঙালি রেস্তোরাঁ, মুদি দোকান, পোশাকের দোকান, আর বাংলা হরফে লেখা সাইনবোর্ডসব কিছুই যেন এক অনন্ত টান তৈরি করল সুব্রত আচার্য এর মনে। তিনি থেমে থেমে চারপাশ দেখছেন, কখনো মসজিদের ছবি তুলছেন, কখনো ভিডিও করেছেন। দেওয়ালে আঁকা বিশাল ম্যুরাল দেখে তিনি কিছুটা থমকে গেলেন। যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল অ, আ, ক, খ। যেন বাংলা ভাষার প্রথম পাঠটি দেয়ালের বুকজুড়ে নতুন করে জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসে থেকেও যেভাবে মানুষ আপন সংস্কৃতি, ভাষা আর স্বাদ-গন্ধকে ধরে রেখেছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
মৃদুল কান্তি সরকার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, “এই জায়গাটা আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশ। আমরা চেষ্টা করি যেন আমাদের পরের প্রজন্মও জানে আমাদের অ, আ, ক, খ কোথা থেকে এসেছে।” সেই মুহূর্তে, হ্যামট্রাম্যাকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে, সুব্রত আচার্য্যের চোখে ভেসে উঠল দূরের বাংলাদেশ। যেখানে মাটির গন্ধ নেই, তবু আছে সংস্কৃতির গভীর শিকড়, ভালোবাসার অমলিন বন্ধন।

দুপুরের খাবার খেয়ে ঘণ্টাখানেকের বিরতি। তারপর স্টার্লিং হাইটস থেকে আবারও যাত্রা করেন হ্যামট্রাম্যাক সিটির পথে। প্রথমেই সৌজন্য সাক্ষাৎ করলেন এসএনএস হোম লোন এবং বাংলা ওয়ান টিভির  কর্ণধার নাসির সবুজ, রিয়েলটর হিমেল দাস, এবং সাংবাদিক সাহেল আহমদ-এর সঙ্গে। উষ্ণ আতিথেয়তা আর আন্তরিক আলাপচারিতায় জমে উঠে সেই বিকেল।
আলোচনার মূল বিষয় ছিল বাংলা সংবাদ মাধ্যমের ডিজিটাল রূপান্তর। কলকাতা কিংবা বাংলাদেশ থেকে শুরু করে প্রবাস পর্যন্ত কিভাবে ডিজিটাল টিভি চ্যানেলের যুগ সাংবাদিকতার ধারা পাল্টে দিচ্ছে, সেই নিয়েই মতবিনিময় করেন সুব্রত আচার্য।
তিনি বলেন, “আজকের বিশ্বে সংবাদ আর শুধু ছাপার অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়; ডিজিটাল মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতেই আমাদের এগোতে হবে। কারণ প্রযুক্তি ও বিশ্বাস, দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।” নাসির সবুজ ও তাঁর সহযোগীরাও একমত হন এই মতের সঙ্গে।

দিনের কর্মব্যস্ততা পেরিয়ে সন্ধ্যায় সুব্রত আচার্য এক আধ্যাত্মিক পর্বে যোগ দেন। দিনটি ছিল শ্যামাপূজা ও দীপাবলীর দিন আলোর উৎসবের রাত্রি। মিশিগানের বিভিন্ন মন্দিরে জ্বলে উঠেছে অসংখ্য প্রদীপের আলো। কোথাও ভেসে আসছে ঘণ্টাধ্বনি, কোথাও ধূপের গন্ধে ভরে উঠছে সন্ধ্যার বাতাস।
এই পবিত্র সন্ধ্যাতেই সুব্রত আচার্য পরিদর্শন করেন রাধাকৃষ্ণ টেম্পল, ডেট্রয়েট দুর্গা টেম্পল, মিশিগান কালী বাড়ি এবং শিব মন্দির টেম্পল অব জয়। প্রতিটি মন্দিরেই তাঁকে স্বাগত জানান স্থানীয় পূজারি ও মন্দির কর্মকর্তারা। এ সময় প্রতিটি মন্দিরে ভক্তরা নিবেদিত প্রাণে পূজার্চনায় ব্যস্ত। তিনি পূজার্চনা উপভোগ করেন।
সুব্রত আচার্য্য মন্দির কর্তৃপক্ষ ও সেবায়েতদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সাক্ষাতকার নেন। দেশ ও প্রবাসের পূজা-আয়োজন, ধর্মীয় চেতনা এবং তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিয়ে মতবিনিময় হয় সৌহার্দ্যের আবহে। তিনি বলেন, “প্রবাসের মাটিতে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুশীলন শুধু আচার নয়, এটি আসলে শিকড়ের টান ধরে রাখার এক নিরব প্রচেষ্টা। এই ধারাবাহিকতা আমাদের জাতিসত্তার অংশ হয়ে উঠেছে।”

পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে ‘প্রথম কলকাতা’র প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত আচার্য তাঁর সফরের দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রতিবেদকের পরিবারের সঙ্গে মিশিগানের বিখ্যাত জার্মান শহর ফ্রাঙ্কেনমুথের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে একটি মলে সামান্য কেনাকাটা সেরে তিনি পৌঁছান ছোট্ট অথচ নৈসর্গিক শহরটিতে। ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপত্য, শান্ত নদী, আর গাছের পাতায় শরতের সোনালি ছোঁয়া। সব মিলিয়ে যেন ছবির মতো শহর।
সন্ধ্যায় তিনি যাত্রা করেন সাগিনা সিটিতে। সেখানে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও দার্শনিক ড. দেবাশীষ মৃধা এবং চিনু মৃধা-র সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় সেই সাক্ষাৎ। মৃধা দম্পতির উষ্ণ আতিথেয়তা ও মনোজ্ঞ আলোচনায় সন্ধ্যাটি হয়ে ওঠে এক স্মরণীয় মিলনমেলা। কথায় কথায় উঠে আসে দর্শন, মানবতা ও প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা।
বুধবার সকালে সুব্রত আচার্য মিশিগান ত্যাগ করেন নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থবহ এই সফর যেন প্রবাসে বাঙালিয়ানা ও সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল বিনিময় হয়ে রইল।
নিউইয়র্কে কয়েকদিন অবস্থানের পর তিনি  ৩১ অক্টোবর কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। পিছনে ফেলে যাবেন মিশিগানের মাটিতে ছড়িয়ে থাকা এক গুচ্ছ উষ্ণ স্মৃতি, বন্ধুত্বের পরশ আর বাংলা সংস্কৃতির অনন্ত টান।

সম্পাদকীয় :

চিনু মৃধা : সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি

সম্পাদক ও প্রকাশক : চিন্ময় আচার্য্য, নির্বাহী সম্পাদক : কামাল মোস্তফা, সহযোগী সম্পাদক : আশিক রহমান,

বার্তা সম্পাদক : তোফায়েল রেজা সোহেল, ফিচার এডিটর : সৈয়দ আসাদুজ্জামান সোহান, স্টাফ রিপোর্টার : মৃদুল কান্তি সরকার।

অফিস :

22021 Memphis Ave Warren, MI 48091

Phone : +1 (313) 312-7006

Email : [email protected]

Website : www.suprobhatmichigan.com